পদ্মা সেতুর পরও উন্নয়নহীন দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান সড়ক
বরিশাল প্রতিনিধি ॥ ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে খানাখন্দের সংখ্যা বেড়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকি চরম আকার ধারণ করেছে। গত কয়েক দিনের হালকা ও ভারী বর্ষণের কারণে সড়কের উপরিভাগ ফেটে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বড়-বড় গর্ত, কোথাও আবার রাস্তা উঁচু হয়ে টিউমারের মতো ফুলে উঠেছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে স্থানীয় বাসিন্দারা নিজেদের উদ্যোগে বাঁশ পুঁতে বিপদসংকেত দিয়ে দিচ্ছেন, যাতে চালকেরা সতর্ক হতে পারেন।সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলার ভূরঘাটা লোকাল বাসস্ট্যান্ড থেকে শুরু করে বরিশাল নতুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত প্রায় ৪৫ কিলোমিটার মহাসড়কজুড়ে ছড়িয়ে আছে ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত। বিশেষ করে ভূরঘাটা থেকে ইল্লা, বার্থী, টরকী, গৌরনদী, বাটাজোরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। শুক্রবার সকাল সাড়ে দশটার দিকে টরকী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় একটি বড় গর্তের পাশে বাঁশ পুঁতে রাখতে দেখা যায়। পিকআপ চালক সুজন ফকির জানান, “বাঁশ দিয়ে চিহ্ন না দিলে রাত-বিরাতে সহজেই বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।”
সড়কের কার্পেটিং উঠে গিয়ে কোথাও কাদা, কোথাও বা একপাশ খুঁড়ে দীর্ঘদিন ফেলে রাখা হয়েছে। ঢেউয়ের মতো উঁচু-নিচু রাস্তা দিয়ে চলাচল এখন ভয়ঙ্কর চ্যালেঞ্জ। এসব জায়গায় যানবাহন ধীরগতিতে চলায় অহরহ যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। দুর্ঘটনা, গাড়ি বিকল হওয়া আর অতিরিক্ত সময় ক্ষতির মধ্যে যাত্রী ও চালকেরা ভুগছেন সবচেয়ে বেশি।
বুধবার গৌরনদী উপজেলার ভূরঘাটা বাসস্ট্যান্ড থেকে উজিরপুরের জয়শ্রী বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার সড়ক ঘুরে দেখা যায়, বিটুমিন ও পাথরের কার্পেটিং উঠে গিয়ে সড়ক মাটির রূপ নিয়েছে। দুই পাশে কেটে রাখা ঢালের মাঝ বরাবর শত শত গর্ত। কোথাও কোথাও দুই পাশে কেটে ফেলায় একটি গাড়ি পাশ কাটিয়ে যেতে পারছে না। ফলে অটোরিকশা, ভ্যান, বাস, ট্রাক সবকিছুই গর্ত এড়িয়ে সতর্কভাবে চলতে বাধ্য হচ্ছে, যা যাতায়াতকে করছে সময়সাপেক্ষ ও বিপজ্জনক।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, প্রসস্থকরণের জন্য দুই পাশ কেটে রাখা হলেও সংস্কার কাজের কোনো অগ্রগতি নেই। জয়শ্রী গ্রামের ব্যবসায়ী রাকিবুল ইসলাম বলেন, “এ রাস্তা পার হতে যেমন গাড়ির ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি সময় লাগছে দ্বিগুণ। বাজারে মাল আনা-নেওয়া কষ্টকর হয়ে পড়েছে।” ভ্যানচালকেরা ঝুঁকি নিতে চান না; নিলেও ভাড়া বাড়িয়ে দেন।
পরিবহন চালকেরা অভিযোগ করে জানান, গর্তে পড়ে চাকা, টায়ার-টিউব ও ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতিটি ট্রিপ শেষে মেরামতে খরচ পড়ছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই গর্তে পানি জমে যায়, ফলে কোথায় গর্ত আছে বোঝা যায় না। এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কা আরও বেড়ে যায়। তারা দ্রুত সংস্কারের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বরিশালের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নাজমুল ইসলামের সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, জুন মাস থেকে টানা বৃষ্টি ও কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়ের কারণে রাস্তার ক্ষতি হয়েছে। বৃষ্টি শেষ হলে সংস্কার শুরু হবে এমনটি শুনেছি।
এদিকে বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়কেও একই চিত্র। ভারী বর্ষণে পিচ নরম হয়ে যানবাহনের চাপে উঠে গিয়ে তৈরি হচ্ছে নতুন গর্ত। পটুয়াখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত প্রায় ৭১ কিলোমিটার জুড়ে ছোট-বড় গর্তে ভরে গেছে সড়ক। মহাসড়কের বাঁকে বাঁকে এই গর্তগুলো দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
পদ্মা সেতু চালুর পর পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটাগামী যানবাহনের সংখ্যা দ্বিগুণ হলেও সড়কের উন্নয়ন হয়নি। প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার যানবাহন এই রুটে চলাচল করে, যার বেশিরভাগই পর্যটন ও পণ্য পরিবহনের সাথে যুক্ত। সড়কের বেহাল দশায় এখন যাত্রীরা অতিষ্ঠ।
শ্যামলী এনআর পরিবহনের চালক কেরামত আলী বলেন, এত গর্ত যে স্টিয়ারিং নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হচ্ছে। গ্রীনলাইন সেবা পরিবহনের চালক মো. ইসমাইল আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে সড়ক আরও নষ্ট হয়ে যাবে।
পটুয়াখালীর পরে সড়কের অবস্থা আরও করুণ হয়ে ওঠে। কুয়াকাটাগামী যাত্রী আল আমিন বলেন, প্রতি কয়েক গজ পরপর ব্রেক কষতে হচ্ছে, সময়ও বেশি লাগছে, দুর্ঘটনার ভয়ও কম নয়।
সওজের বরগুনা অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী কমারেশ বিশ্বাস জানান, বর্ষায় অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে পিচ উঠে গর্ত হয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে ভ্রাম্যমাণ দল কাজ করছে। বরাদ্দ পেলে পূর্ণাঙ্গ সংস্কার হবে। পটুয়াখালী অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মাসুদ করিম বলেন, যাত্রীদের ভোগান্তি কমাতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি।
ঢাকা-বরিশাল ও বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়কের এই ভয়াবহ পরিস্থিতি শুধু যাত্রী ও চালকের নয়, বরং পুরো দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে মনে করেন সচেতন নাগরিকরা। প্রতিদিনের দেরি, যানবাহনের ক্ষতি, পণ্য পরিবহনে ব্যাঘাত এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকিসবকিছু মিলিয়ে দ্রুত সড়ক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা এখন জরুরি দাবিতে পরিণত হয়েছে।
মতামত দিন