যুদ্ধের জয় নেই, মানবতার পরাজয় স্পষ্ট
যুদ্ধ—একটি শব্দ, যা মানবজাতির ইতিহাসে ভয়াবহতা, মৃত্যু, ধ্বংস ও মানবিক বিপর্যয়ের প্রতিচ্ছবি হয়ে রয়েছে। ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে, অস্ত্রের ভাষায় শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তথাকথিত বিজয় লাভের জন্য প্রাণহানি, বাস্তুচ্যুতি, অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং প্রজন্মের পর প্রজন্মে ঘৃণা ও বিভাজনের বীজ বপন করে যায় যুদ্ধ। সাম্প্রতিক বিশ্বরাজনীতি ও ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতগুলো এই সত্যকেই আরও জোরালোভাবে সামনে নিয়ে এসেছে।ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত তারই এক হৃদয়বিদারক উদাহরণ। ২০২৩ সালের শেষ দিক থেকে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নাগরিক নিহত হয়েছেন। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে হাসপাতাল, স্কুল, ত্রাণকেন্দ্রসহ মৌলিক অবকাঠামো। জাতিসংঘের হিসেব মতে, শুধুমাত্র গাজাতেই কয়েক লাখ মানুষ মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। শিশুদের লাশ যখন ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার হয়, তখন কোনো যুক্তি, কূটনীতি বা নিরাপত্তার অজুহাত এই নৃশংসতাকে বৈধতা দিতে পারে না।
এদিকে, ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে বারবার সংঘর্ষের ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন দুই দেশের সৈনিক ও নিরীহ গ্রামবাসী। জম্মু-কাশ্মীর অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর গোলাগুলিতে স্কুলের শিশু থেকে শুরু করে কৃষক—সবাই আতঙ্কে দিন কাটায়। দুই প্রতিবেশী দেশের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা কেবল জনজীবনকে আতঙ্কগ্রস্তই করছে না, বরং এশিয়ার নিরাপত্তা ও উন্নয়নকেও হুমকির মুখে ফেলেছে।
ইসরায়েল-ইরান সম্পর্কও ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। আঞ্চলিক আধিপত্যের প্রতিযোগিতা এবং পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে পারস্পরিক শত্রুতা একসময় একটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের রূপ নিতে পারে—এমন আশঙ্কা আন্তর্জাতিক মহলে জোরালোভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। এমন সংঘাতে কেবল দুই দেশের নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।
এসব যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফলাফল হলো—মানুষের মৃত্যু, ঘরবাড়ি হারানো পরিবার, বিশৃঙ্খল শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা, অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা হ্রাস। যুদ্ধের খরচের বোঝা পড়ে সাধারণ মানুষের উপরেই—যারা কখনো যুদ্ধ শুরু করেনি।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, যুদ্ধ আজ আর শুধুই সামরিক কৌশল নয়, এটি অনেক সময় রাজনৈতিক পুঁজি, অস্ত্র ব্যবসার সুযোগ কিংবা কৃত্রিম সংকট তৈরির একটি হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশ্বশক্তিগুলোর ভ্রান্ত অবস্থান ও নীরব সমর্থনই এসব সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী করছে।
শান্তি কখনোই অস্ত্রের মাধ্যমে অর্জিত হয় না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সংলাপ, কূটনীতি, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং মানবিক মূল্যবোধের মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী সমাধান সম্ভব। বর্তমান বিশ্ব, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলো, এখন অর্থনৈতিক সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন এবং দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এই বাস্তবতায় যুদ্ধ আরও বেশি অনৈতিক, অমানবিক এবং অপ্রয়োজনীয়।
মানবতা যদি টিকে থাকতে চায়, তবে আমাদের শিখতে হবে—শান্তি কেবল বিজয়ের নয়, বরং সহমর্মিতা ও সহাবস্থানের ফল।
লেখা: এম.কে. রানা, গণমাধ্যমকর্মী
মতামত দিন