আন্তর্জাতিক ডেস্ক ॥ পাকিস্তানের ইতিহাসে অত্যন্ত কঠিন এক মুহূর্ত ছিল ১৯৭১ সাল। ঢাকার দখল হারানোকে ‘ঢাকা পতন’ বা ‘পূর্ব পাকিস্তানের পতন’ বলা হয় দেশটির গণমাধ্যমে। সেই সময় পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনালের (পিপিআই) নিউজ রুমে কাজ করছিলেন আদ্রিস বখতিয়ার। সেদিন টেলিপ্রিন্টারে তিন লাইনের একটি খবর পড়ে স্তম্ভিত হয়ে যান, অসাড় হয়ে আসে তার হাত-পা।
খবরটিতে বলা হয়েছিল, পাকিস্তানের লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজি ও ভারতীয় জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছে; যার মাধ্যমে নিয়াজি তার সৈন্যদের নিয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন।
আদ্রিস খবরটি পড়ে কাঁদতে শুরু করেন। নিউজ এডিটরের সামনে খবরটি রাখলে তিনিও এক নজর দেখেই মাথা নিচু করে ফেলেন। এরপর আদ্রিস দাঁড়ানো অবস্থা থেকে মাটিতে বসে পড়েন। তার চোখ বেয়ে তখন অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। তিনি চাননি কেউ তাকে এই অবস্থায় দেখুক।
ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ঘটনা স্মরণে যখনই করাচি ইউনিয়ন অব জার্নালিস্টসের অফিসে মানুষের সমাবেশ হতো, আদ্রিস বখতিয়ার সেদিনের ঘটনাটি মনে করতেন এবং বিষাদভরা কণ্ঠে সাংবাদিকদের সঙ্গে সে সময়ের কথা শেয়ার করতেন।
সম্প্রতি মারা গেছেন পাকিস্তানের এই সাংবাদিক। সেই দিনটিকে স্মরণ করে তিনি বলতেন, ‘‘পাকিস্তানের মানুষের সামনে এই খবর কীভাবে তুলে ধরবো, তা চিন্তা করে কেবল কাঁদছিলাম। আর আমাদের নিউজ এডিটর, যার অনুমতি ছাড়া কোনও খবর প্রকাশিত হতো না; তিনি হাতের ওপর হাত রেখে বসেছিলেন যেন তার আর কিছুই করার নেই।’’
• খবর প্রকাশ পেল কীভাবে?
কী উপায়ে এই খবর জনসমক্ষে প্রকাশ পেল, তা বর্ণনা করছিলেন প্রবীণ সাংবাদিক ও জনপ্রিয় ইংরেজি পত্রিকা পাঞ্জাব পাঞ্চের প্রধান সম্পাদক হুসেইন নাকী। তিনি বলেছিলেন, যখন ঢাকা পতনের খবর পশ্চিম পাকিস্তানে পৌঁছায়, তখন সরকারি মিডিয়ার জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল যে তারা এই খবরটি কীভাবে উপস্থাপন করবে।
পরে পাকিস্তান রেডিওর এক সিনিয়র কর্মকর্তা খবরটি এভাবে উপস্থাপন করেছিলেন, ‘‘দুই স্থানীয় কমান্ডারের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়েছে, যার ফলে যুদ্ধ থেমে গেছে।’’
কিছু পত্রিকায় বলা হয়েছিল, চুক্তির পর ভারতীয় সেনারা ঢাকায় প্রবেশ করেছে। কিন্তু এসব খবর বেশ অস্পষ্টভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল; যাতে জনসাধারণের ওপর তার প্রভাব কম পড়ে।
মূলত পাকিস্তানের তিনটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির কাছে এর কপি দেওয়া হয়েছিল, যারা খবরটি ফোন কল দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিলেন। পরদিন পাকিস্তানের সংবাদপত্রের প্রথম পাতার নিচের পুরো অংশজুড়ে খবরটি প্রকাশিত হয়।
সেদিনই একই পাতায় তখনকার সামরিক শাসক জেনারেল মুহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের সরকারি গণমাধ্যম থেকে প্রকাশিত এক ভাষণ আট কলাম হেডলাইনে ছাপা হয়। যেখানে তিনি ঢাকা পতনের পরও শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
ইয়াহিয়া খান তার ভাষণে স্থানীয় কমান্ডারদের চুক্তির খবরটি এমনভাবে উল্লেখ করেছিলেন যে, একদিকে পিছু হটলেও অন্যদিকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। অথচ পরদিনই ইয়াহিয়া খানের যুদ্ধবিরতির খবর পত্র-পত্রিকায় ছাপানো হয়।
• পাকিস্তানের শাসক শ্রেণির মুজিব বিরোধিতা
ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযানের ঘোষণা দেন। প্রায় তিন মাস আগে, ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে সেখানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করে।
কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এবং সামরিক কর্মকর্তারা শেখ মুজিবকে শাসন ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চাইছিলেন না। ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নির্ধারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ এবং দ্বিতীয় স্থানে থাকা পিপলস পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মধ্যে দফায় দফায় আলোচনা চলে। সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানও ঢাকায় এসে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা করেন। কিন্তু কোনও সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।
সাংবাদিক হুসেইন নাকী মনে করতেন, ‘‘জুলফিকার আলি ভুট্টো এবং ইয়াহিয়া খান— দুজনই চেয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও ভবিষ্যতের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তাদের বড় প্রভাব থাকবে। কিন্তু তাদের এই ইচ্ছা পূরণ সম্ভব হচ্ছিল না। আর এজন্যই সংকট আরও ঘনীভূত হয়ে উঠেছিল।’’
জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ২২ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দ্বিতীয়বার স্থগিত করেন। এতে আওয়ামী লীগ স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ হয়। সরকার-নিয়ন্ত্রিত প্রেস ট্রাস্টের আওতায় প্রকাশিত পত্রিকা মাশরিকের ৩ এপ্রিলের একটি সম্পাদকীয়তে লেখক আখতারুল ইসলাম সিদ্দিকী লিখেছিলেন, প্রেসিডেন্টের আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও শেখ মুজিব অনড় থেকেছেন এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী নীতিকে বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন। তারা পাকিস্তানের পতাকার অবমাননা করেছেন এবং কায়েদ-এ-আজমের (মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ) ছবিও ছিঁড়ে ফেলেছেন।
• পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ জানতো না পূর্ব পাকিস্তানের খবর
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ নওয়ায়ে ওয়াক্ত পত্রিকার প্রধান শিরোনামে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন শহর যেমন রংপুর, চট্টগ্রাম, সৈয়দপুর ও দেওপুরে বিক্ষোভকারী ও সেনাবাহিনীর সংঘর্ষের খবর প্রকাশিত হয়। সেই প্রতিবেদনে জানানো হয়, এসব সংঘর্ষে ৬৪ জন নিহত হয়েছেন।
সেনা সদস্যরা জাহাজ থেকে অস্ত্র নামানোর সময় সংঘর্ষ বেধে যায়। পরের দিনের পত্রিকায় আরও বড় খবর প্রকাশিত হয় :
১. সারা দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ
২. শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার সহযোগীদের দেশদ্রোহী ঘোষণা করে আওয়ামী লীগকে অবৈধ বলে ঘোষণা
৩. পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সামরিক আইন চালু করে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব এবং পুরো প্রদেশে কারফিউ জারি
৪. সারা দেশে সেন্সরশিপ জারি
১৯৭১ সালের মার্চে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু হয়ে যায়। মিলিটারি সরকার সামরিক আইন চালু করে। দিনে দিনে পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতা আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে এবং পরিস্থিতি পশ্চিম পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
সামরিক আইন প্রশাসনের মতে, পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় অখণ্ডতা বিপদের মুখে থাকায় এই পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন ছিল। সেই সময়ে সামরিক আইন থাকায় এবং সেন্সরশিপের কারণে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ জানত না পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটছে।
পশ্চিম পাকিস্তানের পত্রিকাগুলোতে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন খবর প্রকাশিত হচ্ছিল, যার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রবেশ, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের (বাংলাদেশে যারা মুক্তিযোদ্ধা) সমর্থন, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছে অস্ত্র ও বিশাল আর্থিক সাহায্য পাঠানো এবং পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির অবনতি সম্পর্কিত খবর ছিল।
• ভারতের হস্তক্ষেপের নিন্দা
সরকারি নিউজ এজেন্সি ও রেডিও পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের হস্তক্ষেপের খবর প্রচার করে এর প্রতিবাদ জানায়। সেইসঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কার্যক্রমের নিন্দা করে।
পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতিতে ভারতের হস্তক্ষেপের পর পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে যায়। সরকারি নিউজ এজেন্সি অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তান (এপিপি) ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল একটি খবর ছাপায়। এই প্রতিবেদনের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল :
১. আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান চট্টগ্রাম বন্দর ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেছিলেন যা ব্যর্থ করে দেওয়া হয়েছে
২. পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপকভাবে ভারতীয় অস্ত্র বিতরণ করা হচ্ছে
এক কথায় ঢাকা পতনের খবরটি শুধু পাকিস্তানের জনগণের জন্য একটি বড় ধাক্কাই ছিল না, এটি মিডিয়ার ভূমিকা এবং সরকারের আচরণকেও সামনে নিয়ে আসে। সেই একই দিনে, দৈনিক মাশরিক খবর প্রকাশ করে, ‘‘ভারতীয় সরকার একটি তথাকথিত নির্বাসিত বাংলাদেশ সরকার গঠনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে এবং এই সরকার ঘোষণা হলেই ভারত তাকে স্বীকৃতি দেবে।’’
পত্রিকাটিতে রেডিও পাকিস্তানের বরাতে আরেকটি খবরে জানানো হয়, পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের, বিশেষত হিন্দুদের অস্ত্র সরবরাহের পেছনে একটি বড় ভারতীয় ষড়যন্ত্র রয়েছে।
একই পত্রিকায় আরেকটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে শিবির স্থাপন করেছে; যেখানে সন্ত্রাসীদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সরবরাহ এবং তাদের পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হচ্ছে।
এসব খবর পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে ভারতের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল।
• শেখ মুজিবকে দেশদ্রোহী আখ্যা
পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা এই পরিস্থিতিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছিলেন। উইলি খান ভারতীয় হস্তক্ষেপের নিন্দা জানিয়ে একে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন।
মাশরিকের ২৭ মার্চের সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ‘‘চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার জন্য পাকিস্তানকে শাস্তি দিতে পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করার ষড়যন্ত্র করছে আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ।’’
মাওলানা মুফতি মাহমুদ বলেছিলেন, যদি পূর্ব পাকিস্তানে বিদেশি হস্তক্ষেপকে বৈধ মনে করা হয়, তবে পৃথিবীর কোনও দেশই নিরাপদ থাকবে না।
শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, সংকটের সমাধানে বিলম্ব ঘটলে তা বিপর্যয়কর হবে। তবে তার অবস্থান পশ্চিম পাকিস্তানে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এরপর পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং আওয়ামী লীগের নেতাদের দেশদ্রোহী হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়।
ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার লোকজনকে দেশদ্রোহী হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। অন্যদিকে তাদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন কিছু সাংবাদিক ও বিশ্লেষক। শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেপ্তারকে ‘১২ কোটি পাকিস্তানির মনের ইচ্ছার প্রতিফলন’ হিসেবে গণমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া পূর্ব পাকিস্তানে অভিযানের জন্য ইয়াহিয়া খানের সিদ্ধান্তকে ঐতিহাসিক বলে সমর্থন জানানো হয়।
১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চলতে থাকা যুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক রাজনৈতিক নেতা ও সামরিক কর্মকর্তা ভারতের হস্তক্ষেপকে ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ ভারতের লোকসভায় একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল। যেখানে বলা হয়, ভারত বাংলাদেশ স্বাধীনতা আন্দোলনকে পুরোপুরি সমর্থন করবে, যদিও সে সময় বাংলাদেশ ছিল না।
• সংবাদমাধ্যমে একই ধরনের খবর
সেই সময়ের যেমন জামায়াতে ইসলামীর এশিয়া এবং বামপন্থী আল-ফতেহ পত্রিকা, পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় আক্রমণের নিন্দা জানায় এবং দেশের অখণ্ডতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। হোসেন নাকীসহ অন্যান্য সাংবাদিকরা বলেছেন, জামায়াতে ইসলামী এবং বামপন্থীদের মধ্যে আদর্শগত মতভেদ থাকলেও পূর্ব পাকিস্তান প্রসঙ্গে তাদের পত্রিকাগুলোর খবর প্রায় একইরকম ছিল।
পশ্চিম পাকিস্তানের গণমাধ্যমে একটি একপেশে বাণী প্রচারিত হচ্ছিল, যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এবং আওয়ামী লীগের নেতাদের কঠোর সমালোচনা করা হয়। সেলিম মনসুর খালিদ তখনকার প্রকৃত চিত্র ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, সেই সময়ের মিডিয়া শুধু সরকারি বক্তব্য প্রচার করতো।
সরকারি মিডিয়ার উৎস যেমন আইএসপিআর এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বুলেটিন থেকে সাংবাদিকদের খবর সরবরাহ করা হতো। পাকিস্তান টেলিভিশনের সাবেক এক নিউজ ডিরেক্টর নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, সেই সময় খুব কম নেতা বা সাংবাদিক ছিলেন যারা রেডিও ও টেলিভিশনে এসে সরকারি বক্তব্যের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন।
খবরের অনুষ্ঠান ছাড়া তখন আর কোনও প্রোগ্রাম সম্প্রচারিত হতো না। সংবাদ বুলেটিনের পর পাঁচ থেকে সাত মিনিটের খবরের ওপর আলোচনা নামে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার হতো, যেখানে সবাই সরকারের অবস্থানই তুলে ধরতেন।
এই একতরফা দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে পিটিভির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা এক প্রবীণ সাংবাদিক বলেন, দেশ তখন যুদ্ধাবস্থায় ছিল এবং সংবাদ সংগ্রহের উপায় ছিল খুব সীমিত। সরকারি সূত্র ও আইএসপিআর থেকে যে তথ্য দেওয়া হতো, গণমাধ্যম পুরোপুরি সেগুলোর ওপর নির্ভর করতো।
সাংবাদিকরা কীভাবে খবর পেতেন, সেই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাওয়ালপিন্ডির আরএ বাজারে প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্টের একটি প্রেস রুম ছিল। প্রতিদিন একবার, প্রয়োজন হলে দুবার সাংবাদিকদের ব্রিফ করা হতো। এই ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডিরেক্টর জেনারেল ড. মকবুল ভাট্টি, তিন বাহিনীর প্রতিনিধি এবং আইএসপিআর প্রধান ব্রিগেডিয়ার এআর সিদ্দিকী অংশ নিতেন। পূর্ব পাকিস্তানের অভিযান ও যুদ্ধসংক্রান্ত সমস্ত খবর এখান থেকেই সরবরাহ করা হতো। প্রয়োজনে আইএসপিআরও বিবৃতি দিতো।
এমন অবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষও প্রায় একইরকম চিন্তাভাবনা করতো। দেশব্যাপী সেন্সরশিপ থাকায় বিকল্প কোনও মতামত প্রকাশের সুযোগও ছিল না। বিরোধী পক্ষের বক্তব্য তুলে ধরার ক্ষেত্রে পত্রিকাগুলোর কী ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতো তার উদাহরণ পাওয়া যায় ১৯৭১ সালে ১ এপ্রিলের নওয়ে ওয়াক্ত পত্রিকার সংখ্যা থেকে।
সেদিন পত্রিকার সম্পাদকীয় পৃষ্ঠাসহ দুই পাতা কোনও লেখা ছাড়াই ফাঁকা অবস্থায় ছাপা হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের জনমতকে সরকারি বক্তব্যে প্রভাবিত করতে শুধু একতরফা খবর প্রকাশ নয়, বরং সেই খবরের ওপর ভিত্তি করে জনগণের মতামতকে একটি নির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য বিশেষ নিবন্ধও লেখা হতো।
এসব নিবন্ধে আওয়ামী লীগ এবং তাদের নেতৃত্বের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলা হতো এবং তাদের ম্যান্ডেটকে অস্বীকার করা হতো।
উর্দু ডাইজেস্টের সম্পাদক আলতাফ হাসান কোরেশি ‘ভালোবাসার নদী বয়েই যাচ্ছে’ এরকম শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। সাংবাদিক নাকী হোসেন একে সরকারি প্রচারণার অংশ হিসেবে দেখেন।
তবে আলতাফ হাসান কোরেশি এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, উর্দু ডাইজেস্টে আমার এই নিবন্ধমালা ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। তাই এটি ইয়াহিয়া খানের একতরফা প্রচারণার অংশ বলা শুধু ভুলই নয়, বরং লজ্জাজনক।
এই সাংবাদিক নিয়মিত পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন শহর ঘুরে মানুষের সঙ্গে কথা বলতেন। সেখানে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের কিছু অভিযোগের বিষয়ে জানতে পারেন। তাদের এই অভিযোগের শুরু হয়েছিল ১৯৬২ সালের সংবিধান থেকে, যেখানে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন পুরোপুরি বাতিল করা হয়েছিল, অথচ তাদের মূল দাবি ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন।
এছাড়া পূর্ব পাকিস্তানে উৎপাদিত পাট থেকে যে আয় হয়, তার পুরো সুবিধা পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে নিতো। ওই সময়ে, পত্রিকাগুলোয় এসব সব খবর প্রকাশ করা হয়, যেখানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এবং তার ছয় দফা নিয়ে সমালোচনা করা হয়।
আলতাফ হাসানের মতে, এই ধরনের অভিযোগ সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পাকিস্তানকে ভালোবাসতো এবং পাকিস্তানের সঙ্গেই থাকতে চাইত। তারা বিচ্ছিন্নতা চাইত না। তবে এই পর্যবেক্ষণ ছিল ১৯৬৬ সালের। আমার এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই আমি সেই বিখ্যাত নিবন্ধটি লিখেছিলাম, যার শিরোনাম ছিল ‘ভালোবাসার নদী বয়েই যাচ্ছে।’
পূর্ব পাকিস্তানে অভিযান শুরুর আগ পর্যন্ত শেখ মুজিব বা তার সহকর্মী বা দলের বক্তব্য কিছুটা পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমে যাও কিছুটা প্রকাশিত হচ্ছিল, অভিযান শুরুর পর থেকে তাদের দেশদ্রোহী, ভারতের এজেন্ট বা সন্ত্রাসী তকমা দেওয়া হয়।
এসব অভিযোগের বিরুদ্ধে শেখ মুজিব বা তার দলের কোনও সাফাই দেওয়ার সুযোগও দেয়া হয়নি। সেই সময়ে এসব তথ্য জনগণের কাছে কীভাবে পৌঁছেছিল এবং তাদের ওপর এসব খবরের প্রভাব কেমন ছিল তা বুঝতে এক বৃদ্ধার সাথে কথা বলেন সংবাদদাতা।
৮০ বছর বয়সী এই নারী তখন তরুণ বয়সী ছিলেন এবং সে সময়কার প্রথা অনুযায়ী, তিনি ঘরের কাজ করতেন। বাংলাদেশ কীভাবে হয়েছে? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি কিছুটা চিন্তা করে বলেন, ‘‘আমার প্রয়াত স্বামী বলতেন, যদি পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুরা মুজিবকে ভোট না দিতো, তাহলে বাংলাদেশ কখনই আলাদা হতো না।’’ বিবিসি বাংলা।