এম.কে. রানা ॥ ১৬ ডিসেম্বর—বাংলাদেশের ইতিহাসের এক উজ্জ্বলতম দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে বিশ্ব মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র, বাংলাদেশ। ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম এবং দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের ফসল এই বিজয়। মহান বিজয় দিবস তাই শুধু একটি দিন নয়, এটি আমাদের জাতির সংগ্রাম, সাহস এবং আত্মত্যাগের প্রতীক।

বিজয়ের এই মাহেন্দ্রক্ষণ কেবল ইতিহাসের একটি অধ্যায় নয়; এটি আমাদের জাতীয় জীবনের চেতনা, গর্ব এবং ভবিষ্যতের পথচলার পাথেয়। এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় কীভাবে অত্যাচার, শোষণ এবং দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে একটি জাতি একত্রিত হয়ে তাদের অধিকার আদায় করেছিল।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি আদর্শের লড়াই। এটি ছিল গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার এবং মানুষের মর্যাদার জন্য একটি জাতির সংগ্রাম। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামক পরিকল্পনার মাধ্যমে নিরীহ বাঙালির ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়, তখন পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়ায়।

মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট কেবল ভৌগোলিক স্বাধীনতার জন্য ছিল না, এটি ছিল সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যও। বাঙালি জাতি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বৈষম্যের শিকার হয়েছে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, শোষণ এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে এই লড়াই ছিল ন্যায়বিচারের দাবি প্রতিষ্ঠার এক চূড়ান্ত প্রয়াস।

মহান বিজয় দিবস উদযাপন কেবল উৎসবের দিন নয়, এটি আত্মসমালোচনারও একটি দিন। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে এসে আমাদের ভাবতে হবে, আমরা কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে একটি সাম্য ও ন্যায়ের সমাজ গড়তে পেরেছি? দুর্নীতি, সামাজিক বৈষম্য, দারিদ্র্য এবং মানবাধিকারের প্রশ্নে আমরা এখনও অনেক পিছিয়ে আছি। বিজয়ের গৌরব উদযাপনের পাশাপাশি আমাদের এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

তরুণ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস পৌঁছে দেওয়া আমাদের কর্তব্য। বর্তমান সময়ে অনেক ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার অপপ্রয়াস চলছে। এটি আমাদের জাতির জন্য একটি বিপদসংকেত। স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে যে ত্যাগ এবং সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে, তা সঠিকভাবে সংরক্ষণ এবং উপস্থাপন করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।

মহান বিজয় দিবস আমাদের দায়িত্ববোধ জাগ্রত করার দিন। আমাদের নতুন প্রজন্মকে জানতে হবে কেন আমরা যুদ্ধ করেছিলাম এবং কীভাবে আমরা বিজয়ী হয়েছিলাম। আমাদের সংগ্রামের আদর্শ তাদের অনুপ্রেরণা যোগাবে একটি সুশাসিত, সমৃদ্ধশালী এবং মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য।

আজকের দিনে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি সেই সব বীর সন্তানদের, যারা তাদের জীবনের বিনিময়ে আমাদের জন্য স্বাধীনতার সূর্য এনেছিলেন। আমরা স্মরণ করি সেই মা-বোনদের, যারা তাঁদের অমূল্য ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন।

মহান বিজয় দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, স্বাধীনতা কেবল একটি অর্জন নয়, এটি রক্ষা করারও দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হব—এটাই হোক আজকের অঙ্গীকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *