আব্রাহাম লিংকন আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট। খুবই জনপ্রিয়, সুদক্ষ ও সাহসী একজন মানুষ। ছিলেন অতুলনীয় জ্ঞানের অধিকারী এক মনিষী । তার প্রায় প্রত্যেকটা উক্তি খুবই সুন্দর ও বাস্তবমুখী । সেখান থেকে একটি উক্তি ধার করে নিয়ে এসেছি বাংলাদেশের এই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত নন্দিত রাজনৈতিক নেতা তারেক রহমানের দূরদর্শিতা বিশ্লেষণ করার জন্য। তিনি বলতেন,”যদি আমার কাছে একটি গাছ কাটার জন্য আট ঘন্টা সময় থাকে, তাহলে আমি কুড়াল ধার করানোর জন্য সাত ঘন্টা ব্যয় করবো ।”অর্থাৎ এক ঘণ্টা লড়াই করার জন্য প্রয়োজনে সাত ঘন্টা প্রস্তুতি নিতে হবে।
তারেক রহমান বিগত ১৮টি বছর নির্বাসনে থেকে বিএনপি’র মত একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন একটি মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায়। ভিন্নভাবে বলা যায় বৃহৎ রাজনৈতিক দলটিকে তিনি একটি ছাতার নিচে ধরে রাখতে দিনরাত নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন। ঝড় জলোচ্ছ্বাস, দৈব- দুর্বিপাক, দৈত্য দানবের হাত থেকে দলকে রক্ষা করেছেন এবং যুদ্ধ জয়ের জন্য প্রস্তুত করেছেন। তিনি এই দীর্ঘ সময়ে কেবল আড়ালে বসে কুড়ালে ধার দিয়েছেন আর পরিকল্পনা করেছেন একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে হটানোর। আন্দোলন সংগ্রামে বিজয় অর্জন করার জন্য কখনো দু,পা এগিয়েছেন তো এক পা পিছিয়ে এসেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন দীর্ঘ মেয়াদে আন্দোলন সংগ্রাম, জেল জুলুম, নির্যাতন মামলা মোকদ্দমা কোন দলকে সইতে হয় নাই। কিন্তু তিনি থেমে থাকেন নি। প্রায় এক লক্ষ ৪০ হাজার মামলার বিপরীতে ৬০ লক্ষ নেতা কর্মী আসামি। যারা আদালতের বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে জীবনটা শেষ করে দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল বাংলাদেশের আদালত পাড়া যেন বৃহত্তম রাজনৈতিক দল-বিএনপির এক খন্ড অফিস।
বিএনপির এই আন্দোলনের পথ চলা শুরু হয় আক্ষরিক অর্থে ২০০৬ সালে ২৮ অক্টোবর থেকে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে ক্ষমতা হারাতে হয় জনপ্রিয় এই রাজনৈতিক দলটিকে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে জনগণের ভোটের অধিকার হরণ, ভিন্নমত দলন ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। প্রথমে সংবিধান থেকে সবচেয়ে জনপ্রিয় অংশ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধান বাতিল করে জনগণের ভোটের অধিকার হরণ করা হয়। বিএনপি এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেও পেটোয়া বাহিনী দিয়ে তাদের অধিকার দমন করা হয়। শুরু হয় একদলীয় নির্বাচন করার এক মহোৎসব। প্রথমে ২০১৪ সালে বিনা ভোটে নির্বাচন করে বিচার বিভাগ প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে সরকার তার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করে। ২০১৮ সালের আগের রাতে ভোট করার মধ্য দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে রচনা করে আরেক কলঙ্কজনক অধ্যায় । আর ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি একদলীয় কাউন্সিল নির্বাচন করার মধ্য দিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থার চূড়ান্ত কবর রচনা করা হয়। বাংলাদেশের মানুষ এই নির্বাচনের পর বিশ্বাস করতে শুরু করে যে আর কোনদিন এখানে নির্বাচন নামক শব্দটি ব্যবহার করা যাবে না।
কিন্তু হাল ছাড়েননি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি সেই ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধান বাস্তবায়ন করার দাবিতে আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একের পর এক লড়াই চালিয়ে গেছেন। ২০১৫ সালের ৫ই জানুয়ারি গণতন্ত্র হত্যা দিবস পালন করার ঘোষণা দিলে দলটির ওপর নেমে আসে নির্মম নির্যাতনের খড়গ। লক্ষ লক্ষ নেতা কর্মীর নামে হাজার হাজার মামলা দিয়ে তাদের ঘরছাড়া করে ফেলা হয়। সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী কূট কৌশলে কোনঠাসা হয়ে পড়ে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি। কিন্তু তারপরও তারেক রহমানের দক্ষ নেতৃত্বে দলের সব নেতা কর্মী শত নির্যাতন নিপীড়ন উপেক্ষা করে এক ছাতার নিচে অবস্থান নেয়। এটাই ছিল তারেক রহমানের নেতৃত্বের অন্যতম সাফল্য। দলকে গুছিয়ে নিতে অনেকটা ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পাড়া দিতে হয় ২০১৮ সালের নির্বাচনে। কিন্তু তাতে ক্ষতি হয়েছে বলে মনে হয় না। কারণ বিএনপিকে ঠেকাতে আগের রাতেই ভোট করার কারণে শেখ হাসিনা দেশি-বিদেশি রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের চোখে স্বৈরাচারী খেতাব অর্জন করতে সক্ষম হয়।
রাতেও যে ভোট হতে পারে সেটা তিনি যেমন দেখিয়েছেন তেমনি পৃথিবী বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে। সেটা ছিল তারেক রহমানের নেতৃত্বের আরেকটি সাফল্য। এরপর ধীরে ধীরে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিএনপিকে আবার শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে মাঠে নামতে শুরু করে। অতি অল্প সময়ের মধ্যে জনপ্রিয় এসব দাবির স্বপক্ষে সারাদেশের মানুষ সমবেত হতে শুরু করে। বিভাগীয় শহরগুলোতে বিএনপির সমাবেশ দেখে কম্পন সৃষ্টি হয় শেখ হাসিনার আওয়ামী মহলে। কিভাবে বিএনপির সেই জনপ্রিয়তা নস্যাৎ করা যায় সেটা নিয়ে ভাবতে থাকে আওয়ামী মহল যার চূড়ান্ত পদক্ষেপে দেখা যায় ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর। বিশাল জনসমাবেশ ভেঙে দিয়ে দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আবার নতুন করে মামলা মোকদ্দমা দিয়ে ঘরে তুলে দেওয়া হয়। ২০২৪ সালের নির্বাচন নির্বিঘ্ন করতে বলা যায় ঘরছাড়া করা হয় বিএনপি নেতা কর্মীদের। খালে-বিলে নদী-নালায় পোকামাকড়ের সঙ্গে বসবাস করতে হয় তাদের।
তাতেও থেমে থাকেনি বিএনপির নেতাকর্মীরা। সর্বশেষ কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে যখন শিক্ষার্থীরা মাঠে নামে তখন নেপথ্যে সক্রিয় করে তোলা হয় ছাত্রদল যুবদলের নেতা কর্মীদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ যখন বেপরোয়া হয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন তারেক রহমানের নির্দেশেই ছাত্রদল পাশে দাঁড়ায় তাদের। ঢাল হয়ে রক্ষা করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের। এরপর থেকে আন্দোলন সংগ্রামের দিক-নির্দেশনা আসতে থাকে লন্ডন থেকে। যেটা আঁচ করতে পেরেছিলেন শেখ হাসিনা। যে কারণে আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন আবার টার্গেট করা হয় বিএনপি ছাত্রদল যুবদল নেতাকর্মীদের। নির্বিচারে হত্যা করা হয় ছাত্রদল যুবদল নেতা কর্মীদের। দলীয় হিসাব মতে ২৩৭ জন ছাত্রদল কর্মী এই সময় নিহত হয়।হাজার হাজার নেতা কর্মীকে ঘর থেকে তুলে এনে জেলখানায় ঢুকানো হয়। কিন্তু থেমে থাকেননি তারেক রহমান। দ্বিতীয় তৃতীয় স্তরের নেতাকর্মীদের যাত্রাবাড়ী বাড্ডা উত্তরা মোহাম্মদপুর মিরপুর সহ গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পাঠিয়ে আন্দোলন চাঙ্গা রাখেন তিনি। তার সেই দূরদর্শী নেতৃত্বই চূড়ান্ত সাফল্যের মুখ দেখে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছায়। আন্দোলনের পুরো সাফল্যের দাবি তারা করলেও পেছন থেকে তাদেরকে যে সহায়তা দেওয়া হয়েছে সেজন্য কোন কৃতিত্ব নিতে চাননি তারেক রহমান- এখানেই তার উদারতা।
শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর দেশে অরাজকতা সৃষ্টি হতে পারে এমন আশঙ্কার মধ্যে তারেক রহমান নিজ দলের নেতা কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন, “কোন প্রতিহিংসা নয় প্রতিশোধ নয় সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। পাহারা দিতে হবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর মন্দির গির্জা।”তার সেই তাৎক্ষণিক নির্দেশের কারণে আওয়ামীলীগ এবং তাদের আশ্রয় প্রশ্রয়দাতা একটি দেশের সরকার বরাবরের মতো যে হিন্দু কার্ড খেলার পায়তারা করেছিল সেটা ব্যর্থ হয়ে যায়। এখন সামনের দিনগুলোতে দলকে ঠিক আগের মত নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিলেই চলে আসবে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য।
শেষ করবো আমেরিকান লেখক এবং যাজক
জন ক্যালভিন ম্যাক্সওয়েলের লেখা
“Developing The Leader Within You” গ্রন্থের একটি ঘটনা দিয়েঃ “একবার এক ছোট বাচ্চা সিম্ফনির অনুষ্ঠানে গিয়ে এক লোককে দেখে অবাক হয়। সকল যন্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে লোকটা হাত নেড়ে যাচ্ছেন। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর বাচ্চাটি মুগ্ধ হয়ে লোকটিকে প্রশ্ন করেছিলো, আপনার মতো সঙ্গীতজ্ঞ হতে চাইলে আমাকে কী করতে হবে? লোকটি হেসে জবাব দিয়েছিলো, বেশি কিছু না, কেবল কখন কোন বাদ্যযন্ত্র বাজাতে হবে, তার নির্দেশ দেয়া শিখতে হবে। ”
** জন্মদিনে লেখাটি তারেক রহমানকে উৎসর্গ করলেন লেখক
লেখক: আমিরুল ইসলাম কাগজী,সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক