ডেস্ক রিপোর্ট ॥ গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন। এই সরকারের পতনের পর থেকেই সাধারণ মানুষের মুখে যে প্রশ্নটি ঘুরেফিরে বার বার শোনা যাচ্ছে, সেটি হচ্ছে- পরবর্তী সংসদ নির্বাচন কবে হবে?

 

এ অবস্থায় দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। যদিও সরকারের তরফ থেকে এখন পর্যন্ত সে ধরনের কোনো রোডম্যাপ ঘোষণা করতে দেখা যায়নি।

 

 

এ বিষয়ে ক্ষমতা গ্রহণের পর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, কখন নির্বাচন হবে, সেটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়। দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে, আপনারা কখন আমাদের ছেড়ে দেবেন।

 

পরবর্তীতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম দফা সংলাপ শেষে জানানো হয়েছিল যে, দেশের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচনের আয়োজন করা হবে। সে লক্ষ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, সংবিধান সংস্কার ও স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার আনতে ইতোমধ্যে দশটি কমিশন গঠনও করা হয়েছে। আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে কমিশনগুলোর প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। মূলত তারপরই সংস্কারের মূল কাজ শুরু হবে বলে জানা গেছে।

 

কিন্তু সংস্কার করতে ঠিক কত সময় লাগবে এবং কবে নাগাদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে, সে বিষয়ে এখনও সুনির্দিষ্ট করে কিছু জানায়নি সরকার। নির্বাচন নিয়ে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীলরা বিভিন্ন সময় কী বলেছেন সেগুলো তুলে ধরা হলো এখানে।

 

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় বসার মাস দেড়েক পর বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রধান ওয়াকার-উজ-জামান। গত ২৪শে সেপ্টেম্বর প্রকাশিত তার ওই সাক্ষাৎকারে দেশটির পরবর্তী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময়সীমার বিষয়ে প্রথমবারের মতো একটি ধারণা পাওয়া গিয়েছিল।

 

সাক্ষাৎকারে এক প্রশ্নের জবাবে সেনাপ্রধান বলেন, নির্বাচন যাতে আগামী আঠারো মাসের মধ্যে হতে পারে, সেজন্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সম্পন্ন করতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাবো। আমি তার পাশে থাকবো। যা-ই হোক না কেন। যাতে করে তিনি তার কর্মসূচি সম্পন্ন করতে পারেন।

 

গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণ এক থেকে দেড় বছরের মধ্যেই হওয়া উচিৎ। তবে ধৈর্য ধারণের ওপরও জোর দিয়ে সেনাপ্রধান বলেন, আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন তাহলে সেটাই একটা টাইম ফ্রেম (সময়সীমা) হওয়া উচিত, যার মধ্যে একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করতে পারি।

 

তিনি আরও জানান যে, প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধান প্রতি সপ্তাহে সাক্ষাৎ করছেন এবং তাদের মধ্যে অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক বিদ্যমান। দেশকে স্থিতিশীল করতে সরকারের প্রচেষ্টায় সামরিক বাহিনী সমর্থন দিচ্ছে। আমি নিশ্চিত আমরা একযোগে কাজ করলে ব্যর্থ হবার কোনো কারণ নেই। আমি এমন কিছু করবো না যা আমার বাহিনীর জন্য ক্ষতিকর হয়। আমি পেশাদার সৈনিক। আমি আর্মিকে পেশাদার রাখতে চাই। প্রতিষ্ঠান হিসেবে সামরিক বাহিনীকে কখনোই রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা উচিত নয়। সৈনিকের কখনো রাজনীতিতে জড়ানো উচিত না।

 

সরকারের বক্তব্য কী?

নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময়সীমার বিষয়ে সেনাপ্রধান যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, সেটিকে তার ‘নিজস্ব মতামত’ হিসেবে বর্ণনা করেছিল সরকার। সেনাপ্রধানের সাক্ষাৎকার প্রকাশ হওয়ার সপ্তাহখানেকের মাথায় এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসউইং থেকে জানানো হয় যে, নির্বাচনের সময় নির্ভর করবে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ও তা নিয়ে রাজনৈতিক আলোচনার উপরে।

 

গত ৩০শে সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, এটা (নির্বাচন) কবে হবে? ১৬ মাস পর নাকি ১২ কিংবা ৮ মাস পরে সেটা এখনই নির্ধারিত করা যাচ্ছে না। আর আমার মনে হয় যে, সেনাপ্রধান এখানে ওপিনিয়ন দিয়েছিলেন।

 

নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে সরকার ও সেনাপ্রধানের বক্তব্যে মতবিরোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটলো কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখানে মতবিরোধের কোনো বিষয় নেই। সেনাবাহিনী সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান এবং সেনাপ্রধান তার ব্যক্তিগত মত দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা সবসময় বলে আসছেন, নির্বাচন কখন হবে এটা জনগণ ঠিক করবে।

 

তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের আগে সংস্কারের কিছু বিষয় আছে। এসব বিষয়ে কমিশন গঠন করা হয়েছে। কমিশন কাজ শুরুর আগে এগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা হবে। সেখানে যেভাবে মতৈক্য হবে তার ভিত্তিতেই নির্বাচন কমিশন সংস্কার ও পুনর্গঠন হবে। তারপরই কমিশন নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণা করবে। সে কারণেই আমি বলেছি যে, এটা ১২মাস, ১৬ মাস কিংবা দু’বছর হতে পারে। এটা এখনি তো বলা যাচ্ছে না। এজন্যই আবারও বলছি যে, কখন নির্বাচন হবে, সেটি ঠিক করবে জনগণ।

 

ভয়েস অব আমেরিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস নির্বাচনের তারিখ সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমাদের মুখ থেকে যখন শুনবেন, সেটাই হবে তারিখ।

 

এছাড়া মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনপিআরকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ ও নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা। সাক্ষাৎকারে ‘আপনার যা (সংস্কার কাজ) করতে হবে, তার জন্য ১৮ মাস সময় কি যথেষ্ট?’- প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, কেউ কেউ বলছে যত দ্রুত সম্ভব সংস্কার করার জন্য, না হয় আপনি (অধ্যাপক ইউনূস) যত দেরি করবেন, তত অজনপ্রিয় হয়ে পড়বেন। সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাবে। আবার কেউ কেউ বলছে, না, আপনাকে অবশ্যই এই সংস্কার শেষ করতে হবে। তাই আপনাকে এই দীর্ঘ সময় থাকতে হবে। কারণ, সবকিছুর সংস্কার না করে আমরা বাংলাদেশ ২.০-তে যেতে চাই না। তাই এই বিতর্ক চলছে।

 

তবে আগামী বছরের মধ্যে নির্বাচন করাটা সম্ভব হতে পারে বলে সম্প্রতি জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। গত ১৭ই অক্টোবর রাতে একটি বেসরকারি চ্যানেলের দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমার কাছে মনে হয়, আগামী বছরের মধ্যে নির্বাচন করাটা হয়তো সম্ভব হতে পারে। অনেক ফ্যাক্টর রয়েছে। এটা প্রাইমারি অ্যাজাম্পসন (প্রাথমিক অনুমান)।

 

নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারকে অনেকগুলো ধাপে কাজ করতে হবে জানিয়ে আইন উপদেষ্টা আরও বলেন, নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রথম কাজ হবে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা। আপনি নিশ্চয় ভুয়া নির্বাচন কমিশন থেকে নির্বাচন করা হোক, সেটা চান না। নিশ্চয় কেউ চায়নি হাবিবুল আউয়াল কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন করে দেবে। এটা কেউ কল্পনাও করতে পারে না।

 

আইন উপদেষ্টার এমন বক্তব্যের পর নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে নতুন করে বিভিন্ন মহলে আলোচনা শুরু হয়। সাধুবাদ জানিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনের দিনক্ষণের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার দাবি জানায় বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলো।

 

এমন পরিস্থিতির মধ্যেই একদিন পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেন আইন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পলিসি ডিসিশন। এটি সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে ঠিক হবে। তিনিই একমাত্র নির্বাচনের সময় ঘোষণার এখতিয়ার রাখেন। আমি বলেছি নির্বাচন হয়তো আগামী বছরের মধ্যে সম্ভব হতে পারে, তবে এ ক্ষেত্রে অনেকগুলো ফ্যাক্টর রয়েছে। সেখানে এসব ফ্যাক্টর পুরোপুরি ব্যাখ্যা করার সুযোগ পাইনি। কিন্তু আমাদের সরকারের কথা থেকে সবাই বুঝবেন যে নির্বাচনের জন্য সংস্কার ও রাজনৈতিক সমঝোতার কথা বলা হয়। এগুলোই সেই ফ্যাক্টর।

 

নিজ বক্তব্যের ব্যাখ্যায় আইন উপদেষ্টা আরও বলেন, এই শর্তভিত্তিক ধারণা ও অনুমানকে কিছু গণমাধ্যম নির্বাচনের সময় ঘোষণা হিসেবে দেখাচ্ছে। এটা সঠিক নয়।

 

 

দলগুলো কী বলছে?

নির্বাচন নিয়ে এতো আলোচনা হতে দেখা গেলেও এর সময়সীমার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে সংস্কারের পর নির্বাচনের কথা বলা হলেও বিএনপি চাচ্ছে, দ্রুত সময়ের মধ্যে ভোট হোক।

 

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্বাচন যত দ্রুত হবে ততই জাতির জন্য মঙ্গল হবে। সংস্কার প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ জরুরি। সেজন্যই নির্বাচনের দরকার।

 

চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপে আবারও নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি তুলেছে বিএনপি। এ সময় তিনি বলেন, নির্বাচন আমাদের এক নম্বর প্রায়োরিটি। তবে নির্বাচনের রোডম্যাপে আমরা সরকারের কাছে কোনও মাস দিনকাল নিয়ে কথা বলিনি।

 

এছাড়া সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আগামী জাতীয় নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে নানা ধরনের বক্তব্য দেয়ায় জনমনে সন্দেহ-সংশয় তৈরি হচ্ছে বলেও মনে করে বিএনপি। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেই এ সংশয়ের প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সম্প্রতি বিএনপির এক অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি অংশ নিয়ে তিনি বলেন, এমন একটি কাঙ্ক্ষিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে সরকারের বক্তব্যের গড়মিল জনগণের মনে নানা ধরনের সন্দেহ-সংশয়ের উদ্রেক করে। জনগণ অন্তর্বর্তী সরকারকে আরও দায়িত্বশীল গণমুখী ও কার্যকর দেখতে চায়।

 

বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন বলছেন, নির্বাচন নিয়ে সরকারের যে কোনও রোডম্যাপ নেই, সেটিই উঠে এসেছে সরকার সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যে। তারেক রহমান জনগণের সংশয়কে তুলে ধরেছেন, কারণ সরকার তাদের টার্গেট এবং নির্বাচনি রোডম্যাপ এখনো ঠিক করতে পারেনি। এ কারণেই একেক জন একেক ধরনের কথা বলছেন। আমরা মনে করি সরকারের এই অস্পষ্টতার কারণেই জনমনে উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে।

 

অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনের আগে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে জোর দিয়ে আসছে। সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও অর্থবহ করার জন্য নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। সংস্কার ব্যতীত নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে পারে না।

 

এ সময় আইন, বিচার, সংসদ, নির্বাচন ব্যবস্থাসহ রাষ্ট্রের সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ১০ দফা প্রস্তাবও তুলে ধরেছে জামায়াতে ইসলামী।

 

লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), গণফোরাম, গণঅধিকার পরিষদসহ আরও কয়েকটি দলও মনে করে যে, সংস্কার শেষে তবেই নির্বাচন হওয়া উচিৎ।

 

গত ১৯শে অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপকালে রাষ্ট্র সংস্কারের পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানান গণফোরামের নেতা ড. কামাল হোসেন।

 

বাংলাদেশ বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি এবং ১২ দলীয় জোটের নেতারা মনে করেন যে, ২০২৫ সালের মধ্যেই বাংলাদেশের পরবর্তী সংসদ নির্বাচন হওয়া উচিৎ। সূত্র: বিবিসি বাংলা

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *